Thursday, November 17, 2011

আট বছর আগে একদিন / জীবনানন্দ দাশ

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ ।
বধু শূয়েছিল পাশে- শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল- জোৎস্নায় - তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার ।
এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি !
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মত ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার ;
কোনদিন জাগিবে না আর ।
‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম-অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে গেলে-অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে ।
তবুও তো প্যাঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
কয়েকটি প্রভাতের ইশারায় -অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে ।
টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থাকে জীবনের স্রোত ভালবেসে ।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি ;
সোনালী রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি ।
ঘনিষ্ট আকাশ যেন-কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছ ইহাদের মন ;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িংয়ের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে ‘পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে নিয়ে গিয়েছিলে তবু একা-একা,
যে জীবন ফড়িংযের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা ,
-এই জেনে।
অশ্বথের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকীর ভিড় এসে সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করে নি কি মাখা মাখি ?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলেনি কি : ‘ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! —
ধরা যাক দু’-একটা ইঁদুর এবার !’
জানায়নি প্যাঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার ?
জীবনের এই স্বাদ- সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের-
তোমার অসহ্য বোধ হল;
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো
মর্গে - গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে !
শোনো
তবুও এ মৃতের গল্প; - কোন
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই ;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোন খাদ ।
সময়ের উদবর্তনে উঠে আসে বধু
মধু- আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি কোন বেদনার শীতে
এ জীবন কোন দিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শূয়ে আছে টেবিলের ‘পরে ।
জানি- তবু জানি
নারীর হৃদয়- প্রেম- শিশূ-গৃহ- নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় -
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত- ক্লান্ত করে ;
লাশ কাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে ।
তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয়ঃ ‘ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর এবার –
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হবো - বুড়ি চাঁদটারে আমি
ক'রে দেব কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দু'জনে মিলে শূন্য ক'রে চ'লে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।
(মহাপৃথিবী : জীবনানন্দ দাশ)

No comments:

Post a Comment